অধ্যায় ১০ : খন্দক যুদ্ধ থেকে হুদায়বিয়ার সন্ধি

খন্দকের যুদ্ধ

মদীনা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বনু নযীর গোত্রের লোকেরা ইসলামের বিরুদ্ধে এক বিরাট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা আশপাশের গোত্রগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুললো। মক্কায় গিয়ে কুরাইশদেরকে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলো এবং এই মর্মে প্রস্তাব দিলো যে, সবাই মিলে এক সংগে হামলা করলে এই নয়া আন্দোলনকে খুব সহজে ধ্বংস করে দেয়া যাবে। কুরাইশরা এরূপ প্রস্তাবের জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। অবশেষে ইহুদী ও কুরাইশদের সমবায়ে প্রায় দশ হাজার লোকের এক বিরাট বাহিনী গঠিত হলো।

হযরত (স) মদীনা আক্রমণের এই বিপুল আয়োজন সম্পর্কে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। হযরত সালমান ফারেসীর (রা) পরামর্শ দিলেন যে, এতো বড়ো বাহিনীর সঙ্গে খোলা ময়দানে মুকাবিলা করা সমীচীন হবে না। আমাদের সৈন্যদেরকে মদীনার নিরাপদ স্থানেই থাকতে হবে এবং দুশমনরা যাতে সরাসরি হামলা করতে না পারে, সেজন্যে নগরীর চারদিকে পরিখা (খন্দক) খনন করতে হবে। ৪৪ এই অভিমতটি সবার মনোপুত হলো এবং পরিখা খননের প্রস্তুতি চলতে লাগলো।

খন্দকের প্রস্তুতি

মদীনার তিন দিক ঘর-বাড়ি ও খেজুর বাগান দ্বারা পরিবেষ্টিত আর একদিক মাত্র উন্মুক্ত ছিলো। হযরত (স) তিন হাজার সাহাবী নিয়ে সে উন্মুক্ত দিকেই পরিখা খননের আদেশ দিলেন। পঞ্চম হিজরীর ৮ জিলকদ এই খনন কার্য শুরু হলো। হযরত (স) নিজে পরিখার খনন কাজ উদ্বোধন করলেন এবং প্রতি দশজন লোকের মধ্যে দশ গজ ভূমি বন্টন করে দিলেন। পরিখার প্রস্ত পাঁচ গজ এবং গভীরতা পাঁচ গজ। বিশ দিনে তিন হাজার মুসলমান এ বিরাট পরিখা খনন করে ফেললেন। পরিখা খননকালে হযরত (স) সকল লোকের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত রইলেন। ঘটনাক্রমে এক জায়গায় একটি বিরাটাকার পাথর সামনে পড়লে। সেটাকে কোনো প্রকারেই ভাঙা যাচ্ছিলো না। হযরত (স) সেখানে গিয়ে এরূপ জোরে কোদাল মারলেন যে, পাথরটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। এ ঘটনাও নবী করীম (স)-এর একটা বিশিষ্ট মু’জিজা।

কাফিরদের হামলা

কাফিরদের সৈন্য বাহিনী তিন দলে বিভক্ত হয়ে তিন দিক থেকে মদীনার ওপর হামলা করলো। এই হামলা ছিলো অত্যন্ত প্রচণ্ড ও ভয়াবহ। কুরআন পাকের সূরা আহযাব এর ১০ এবং ১১ নং আয়াতে নিম্নোক্ত ভাষায় এই হামলার চিত্র আঁকা হয়েছেঃ
যখন দুশমনরা ওপর (পূর্ব) ও নীচের (পশ্চিম) দিক থেকে তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, যখন চক্ষু ফেটে যাবার উপক্রম হলো এবং কলিজা মুখের কাছে আসতে লাগলো আর তোমরা খোদা সম্পর্কে নানারূপ সন্দেহ করতে লাগলে, ঠিক তখন মুমিনদের পরীক্ষার সময় এলো বেং তীব্রভাবে ভূ-কম্পন সৃষ্টি হলো।

এটা ছিলো বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার সময়। একদিকে প্রচণ্ড শীতকাল, খাদ্য-দ্রব্যের অভাব, উপর্যুপরি কয়েক বেলা অনশন, রাতের নিদ্রা আর দিনের বিশ্রাম উধাও, প্রতিটি মুহূর্ত জীবনের ভয়, মালমাত্তা ও সন্তানাদি দুশমনের আঘাতের মুখে আর অন্যদিকে বেশুমার শত্রু সৈন্য । এমনিতরো সংকটাবস্থায় যাদের ঈমান ছিলো সাচ্চা ও সুদৃঢ়, কেবল তারাই সত্যের পথে অবিচল থাকতে পারছিলো। দুর্বল ঈমানদার ও মুনাফিকগণ এ পরিস্থিতির আদৌ মুকাবিলা করতে পারছিলো না; বরং মুসলমানদের সমাজ-সংগঠনে যে সব মুনাফিক অনুপ্রবেশ করেছিলো, তারা এ সময় খোলাখুলিভাবে আত্নপ্রকাশ করলো। তারা বলতে শুরু করলো : ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের কাছে বিজয় ও সাহায্যের যে ওয়াদা করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ ধোকা।’ (আহযাব:আয়াত ১২) । এর পাশাপাশি তারা নিজেদের জান বাঁচানোর জন্যে নানারূপ বাহানা তালাশ করতে লাগলো এবং : ‘হে মদীনাবাসী! ফিরে চলো, আজ আর তোমাদের রক্ষা নেই।’ তারা নবী করীম (স) -এ সামনে এসে বলতে শুরু করলোঃ ‘আমাদেরকে ঘর-বাড়িতে থেকে আত্নরক্ষা করার অনুমতি দিন; আমাদের বাড়ি-ঘর সম্পূর্ণ অরক্ষিত।’ (আহযাব : আয়াত ১৪)।

কিন্তু যাদের ভেতর যথার্থ ঈমান ছিলো এবং যারা ঈমানের দাবিতে ছিলো সত্যবাদী, এ সময় তাদের অবস্থা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা কাফিরদের সৈন্য-সামন্ত দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলো :

‘আল্লাহ এবং রাসূল তো আমাদের সঙ্গে এরই (অবস্থার) ওয়াদা করেছিলেন। পরন্ত এ অবস্থা দেখে তাদের ভেতর ঈমানের ভাবধারা আরো সতেজ হয়ে উঠলো এবং অধিকতর আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তিতার জন্যে তারা প্রস্তত হলো। এই কঠিন অবস্থা তাদের ভেতরে অনু পরিমাণও পরিবর্তন ঘটাতে পারলো না। (সূরা আহযাব : ২২ ও ২৩ আয়াত)

দুশমনরা প্রায় এক মাসকাল মদীনা অবরোধ করে রইলো। এই অবরোধ এতো কঠিন ছিল যে, মুসলমানদেরকে একাধিক্রমে তিন-চার বেলা পর্যন্ত অনশনে কাটাতে হলো। এভাবে অবরোধ অত্যন্ত কঠিন ও বিপজ্জনক রূপ পরিগ্রহ করলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবরোধকারীরা কিছুতেই পরিখা পার হতে পারলো না। এ কারণে তারা অপর পারেই অবস্থান করতে লাগলো। হযরত (স) তাঁর সৈন্যদেরকে পরিখার বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। কাফিররা বাহির থেকে পাথর ও তীর ছুঁড়তে লাগলো। এদিক থেকেও তার প্রত্যুত্তর দেয়া হলো। এরই ভেতর বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি হামলাও চলতে লাগলো। কখনো কখনো কাফিরদের আক্রমণ এতো তীব্রতর রূপ ধারণ করতে লাগলো যে, তাদেরকে পরিখার এপার থেকে প্রতিহত করার জন্যে পূর্ণ দৃঢ়তর সাথে মুকাবিলা করতে হলো। এমন কি এর ফলে দু-একবার নামায পর্যন্ত কাযা হয়ে গেলো।

আল্লাহর সাহায্য

অবরোধ যতো দীর্ঘায়িত হলো, হানাদাদের উৎসাহও ততোটা হ্রাস পেতে লাগলো। দশ-বারো হাজার লোকের খানাপিনার ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ কাজ ছিলো না। তদুপরি ছিলো প্রচণ্ড শীত। এরই মধ্যে একদিন এমনি প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইলো যে, কাফিরদে সমস্ত ছাউনি উড়ে গেলো। তাদের সৈন্য-সামন্ত ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেলো। তাদের ওপর যেন খোদার মূর্তিমান আযাব নেমে এলো। আর বাস্তবিকই আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের জন্যে রহমত এবং কাফিরদের জন্যে আযাব হিসেবেই এ ঝড় প্রেরণ করেছিলেন। এই ঘটনাকে আল্লাহ তাঁর একটি অনুগ্রহরূপে আখ্যায়িত করে বলেছেনঃ

‘হে মুমিনগণ! খোদার সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন তোমদের ওপর সম্মিলিত বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আর আমি তাদের ওপর প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা বইয়ে দিলাম এবং এমন সৈন্য (ফেরেশতা) পাঠালাম, যা তোমরা দেখতে পাওনি। (সূরা আহযাব : আয়াত ৯)

তাই কাফিরগণ এ পরিসি'তির মুকাবিলা করতে পারলো না। তাদের মেরুদণ্ড অচিরেই ভেঙে পড়লো। অবস্থা বেগতিক দেখে ইহুদীরা আগেই কেটে পড়েছিলো। এখন বাকী রইলো শুধু কুরাইশরা। তাই তাদেরও ফিরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। এভাবে শুধু আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর অদৃশ্য সাহায্যে মদীনার আকাশে ঘনীভূত ঘনঘটা আপনা-আপনি কেটে গেলো। কুরআন মজীদে এই যুদ্ধের কাহিনী যে ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে এবং তাতে মুসলমানদের প্রশিক্ষণের জন্যে যে সব উপাদান রয়েছে, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় নিম্নে উদ্ধৃত করা যাচ্ছে।

আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর ভরসা

মুমিনের প্র্যয় হচ্ছে এই যে, প্রকৃত শক্তি আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। বিশ্বজাহানে যা কিছু ঘটে, তা শুধু তাঁরই অভিপ্রায় ও হুকুম অনুসারে ঘটে থাকে। মুমিন তার কোনো সাফল্যকেই আপন চেষ্ট-সাধনা বা নিজস্ব শক্তির ফল মনে করে না; বরং তাকে মনে করে আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ (ফযল)। দৃষ্টন্ত স্বরূপ বলা যায়ঃ খন্দক যুদ্ধের সময় দশ-বারো হাজার কাফির সৈন্য তিন হাজার মুসলমানের কোনোই ক্ষতি করতে পারলো না; বরং তাদেরকে দিশেহার হয়ে ফিরে যেতে হলো। এই পরিস্থিতিকে কিছু মুসলমান হয়তো নিজেদের চেষ্টা-তদবিরের (পরিখা খননের) ফল মনে করতে পরতো। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে এই দুর্বলতা থেকে বাঁচানোর জন্যে পূর্বাহ্নে ইরশাদ করলেনঃ ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন তোমাদের ওপর সম্মিলিত বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং আমরা তাদের ওপর প্রচণ্ড ঝড় বইয়ে দিলাম আর এমন সৈন্য পাঠালাম, যা তোমরা দেখতে পাওনি’। (আহযাবঃ ৯)

বস্তত ইসলামী আন্দোলনের অনুবর্তীদের জন্যে এরূপ নৈতিক প্রশিক্ষণই একান্ত প্রয়োজন। তাদের প্রতি মুহূর্ত এটা স্মরণরাখা আবশ্যক যে, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি যতো বড়োই হোক না কেন, তারা শুধু আল্লাহর অনুগ্রহের ওপরই ভরসা করবে এবং তাঁকেই সমস্ত কাজের নিয়ামক মনে করে দ্বীন-ইসলামের জন্যে সর্বাত্নক চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকবে।

ঈমানের দাবি যাচাই

মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয় দুঃখ-কষ্ট ও মুসিবতের সময়। তখন সে নিজে যেমন নিজের অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারে, তেমনি অপরেও আন্দাজ করতে পারে যে, এই পথে সে কতোখানি অবিচল থাকতে সক্ষম। স্বাভাবিক অবস্থায় বহু লোক সম্পর্কেই এটা অনুমান করা যায় না যে , উদ্দেশ্যের প্রতি স্বাভাবিক ভালবাসা এ জীবন পণ করার সংকল্পে তারা বাস্তবিকই কতোটা প্রস্তুত, বরং কখনো কখনো তারা নিজেরাই নিজেদের সম্পর্কে একটা ধোকায় পড়ে থাকে। কিন্তু যখন কোনো সংকটকাল আসে, তখন আসল ও মেকীর পার্থক্যটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। খন্দক যুদ্ধ এই কাজটিই করেছে। মদীনার মুসলমানদের দলে এক বিরাট সংখ্যক মুনাফিক ও মেকী ঈমানদার ঢুকে পড়েলিলো। তাদের সত্যিকার পরিচয়টা সাধারণ মুসলমানদের সামনে উদঘাটন করার প্রয়োজন ছিলো।

তাই এই সংকটের মাধ্যমে তাদের মুখোসটি খসে পড়লো। ক্রমাগত পরিখা খনন করা, খানাপিনা ও আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে রাত-দিন একাকার করে দেয়া, একটি বিরাট বাহিনীর মুকাবিলার জন্যে জীবন হাতে নিয়ে তৈরী থাকা, সর্বোপরি কুড়ি-বাইশ দিন পর্যন্ত ক্রমাগত ভীতি ও শংকার মধ্যে রাতের ঘুম ও দিনের বিশ্রাম হারাম করে দেয়া কোনো সহজ কাজ ছিলোনা। তাদের অনেকেই বরং বলতে লাগলো : ‘রাসূল আমাদের কাছে বিজয় ও সাহায্যের ওয়াদা করেছিলেন; কিন্তু এখন তো দেখছি হাওয়া ঘুরে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পেরেছি, আল্লাহ ও রাসূল আমাদের কাছে যে ওয়াদা করেছিলেন তা নিছক একটি ধোকা মাত্র।’ (আহযাব)। কিছু লোক আবার নানারকম বাহানা তালাশ করে ফিরছিলো। তারা আপন ঘর-বাড়ির হেফাজতের বাহানায় ময়দান থেকে সরে পড়লো। পক্ষান্তরে আল্লাহর যে সব বান্দাহ সাচ্চা ঈমানের অধিকারী ছিলো, তারা এ অবস্থায় স্বতন্ত্র ভূমিকা গ্রহণ করলো। তারা শত্রু সৈন্যদেরকে এগিয়ে আসতে দেখেই বলতে লাগলো : ‘ঠিক ঠিক এমনি অবস্থার কথাই আল্লাহ এবং রাসূল আমাদেরকে আগে জানিয়েছিলেন, আল্লাহ ও রাসূল তো এরই ওয়াদা করেছিলেন আমাদের কাছে। আল্লাহ ও রাসূল তো সত্য কথাই বলেছেন। এই অবস্থায় তাদের ভেতর ঈমানের শক্তি আরো বৃদ্ধি পেলো এবং তারা অধিকতর আনুগত্য ও ফর্মাবরদারির জন্যে প্রস্তুত হলো।’ (আহযাব)

দুর্বলতার উৎস-২

জান ও মালের ক্ষতির আশঙ্কা হচ্ছে মানুষের সবচাইতে বড়ো দুর্বলতা; বরং বলা চলে, সমস্ত দুর্বলতার মূল উৎস। আল্লাহর সত্ত্বা ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে ইসলাম যে ধরণের ঈমান আনার দাবি জানায়, তাতে মূলগতভাবে এই আকীদা শামিল রয়েছে যে, জীবন-মৃত্যু, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি সবকিছুই আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। অপর কোনো শক্তি মৃত্যুকে বিলম্বিত করতে পারে না। এমনি প্রত্যয় এবং এমনি ঈমানই হচ্ছে শক্তির মূল ভিত্তি। এই ভিত্তি যতোটা দুর্বল হবে, মুসলমানের প্রতিটি কাজে ততোটা দুর্বলতাই প্রকাশ পাবে। তাই এই দুর্বলতাকে দূর করার জন্যে সুস্পষ্টভবে জানিয়ে দেয়া হলোঃ ‘হে নবী! তাদেরকে বলে দিন যে, তোমরা যদি মৃত্যু বা হত্যার ভয়ে পালাতে চাও তো পালিয়ে দেখ; এরূপ পলায়নে তোমাদের কোনোই ফায়দা হবে না। তাদেরকে আরো বলে দিন যে, (তারা চিন্তা করে দেখুব) আল্লাহ যদি তাদের কোনো ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাদেরকে আর কে বাঁচাতে পারে? আর যদি আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন তাদের কোনো উপকার করার, তাহলে তাঁকে আর কে প্রতিরোধ করতে পারে? (তাদের স্মরণ রাখা উচিত যে,) আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে না পাবে পৃষ্ঠপোষক আর না পাবে মদদ্গার।’ (আহযাব : আয়াত ১৭)

রাসূলের অনুকরণীয় আদর্শ

এই যুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনার মধ্যেই মুসলমানদেরকে এ কথা জানিয়ে দেয়া হলো যে, রাসূল (স) -এর জীবন হচ্ছে তোমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ। তবে যারা আল্লাহ তা’আলার দীদার এবং আখিরাতের প্রাপ্য পুরস্কারের প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে খুব বেশি পরিমাণ স্মরণ করে, এ আদর্শ থেকে কেবল তারাই ফায়দা হাসিল করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইসলামপন্থীদের মনোবল বজায় রাখা এবং চরম সংকটকালে তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় রাখার জন্যে পূর্ণ ধৈর্য-স্থৈর্য, কঠোর সংকল্প ও খোদা-নির্ভরতার কিছু নমুনা পেশ করা হলো। যারা আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবে কায়েম কতে ইচ্ছুক এবং এ উদ্দেশ্যেই এ পথের অগ্রপথিক, খোদার সেইসব বান্দার জন্যে এ নমুনা কিয়ামত পর্যন্ত অনুকরণযোগ্য হয়ে থাকবে। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ নমুনা তাদের সামনে রাখা উচিত। কারণ এ-ই হচ্ছে তাদের জন্যে প্রকৃত আলোকবর্তিকা।

বনু কুরায়জার ধ্বংস

ইতঃপূর্বে বিবৃত হয়েছে যে, হযরত (স) মদীনায় আসার পর ইহুদীদের বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন। প্রথম দিকে কিছুদিন ইহুদীরা সে সব চুক্তির ওপর অটল থাকলেও অত্যল্প দিনের মধ্যেই তারা বেপরোয়া ভাবে চুক্তি ভঙ্গ করতে লাগলো। এর ফলে তাদের বনু নযীর গোত্রকে মদীনার থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছিলো; কিন্তু বনু কুরায়জা আবার চুক্তি সম্পাদন করেলো এবং হযরত (স) তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে আপন কিল্লায় থাকার অনুমতি দিলেন।

কিন্তু খন্দক যুদ্ধের সময় ইহুদী গোত্রসমূহ বনু কুরায়জাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দিলো এবং তারাও এ যুদ্ধে শত্রু পক্ষে যোগদান করলো। তারা হযরত (স)-এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কোনোই মর্যাদা রাখলো না। তাই খন্দকের ঘনঘটা কেটে যাবার পরই হযরত (স) সর্বপ্রথম বনু কুরায়জার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন এবং তাদেরকে এ বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে যথোচিত শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের অপরাধ ছিলো বনু নযীরের অপরাধের চেয়েও মারাত্নক। কেননা তারা এরূপ এক সংকটাবস্থায় বিশ্বাসঘাতকতা করলো, যখন গোটা আরব জনগোষ্ঠী মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং দৃশ্যত তাদের টিকে থাকবার আর কোনো উপায় ছিলো না। তারা মুসলমানদের সাথে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে চুক্তি নির্মমভাবে লংঘন করে তারা মুসলমানদের নাস্তানাবুদ করার উদ্দেশ্যে শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলালো। এভাবে নিজেদের আচরণ দ্বারাই বনু কুরাইয়জা এটা প্রমাণ করে দিয়েছিলো যে, তারা মুসলমানদেতর পক্ষে প্রকাশ্য শত্রুর চেয়েও বেশি মারাত্নক ।

তাই যুদ্ধের পর হযরত (স) তাদের কিল্লা অবরোধ করলেন। অবরোধ প্রায় এক মাসকাল অব্যাহত থাকলো। অবশেষেষ বাধ্য হয়ে তারা আত্নসমর্পণ করলো। অতঃপর তাদের ধর্মগ্রন্থ তওরাতের বিধি মুতাবেক এই মর্মে ফয়সালা করা হলো যে, তাদের সমস্ত যুদ্ধোপযোগী লোককে হত্যা করা হবে এবং বাকী লোকদের বন্দী করে রাখা হবে। এছাড়া তাদের সমস্ত মালপত্র বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই ফয়সালা অনুসারে প্রায় চারশ লোককে হত্যা করা হলো। এর মধ্যে একজন মহিলাও ছিলো। তার অপরাধ ছিলো এই যে, সে কিল্লার প্রাচীরের ওপর থেকে পাথর ফেলে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছিলো।

হুদাইবিয়া সন্ধির পটভূমি

কা’বা ছিলো ইসলামের মূল কেন্দ্র। এটি আল্লাহর নির্দেমানুক্রমে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) নির্মাণ করেছিলেন। মুসলমানরা ইসলামের এই কেন্দ্রস্থল থেকে বেরোবার পর ছয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছিলো। পরন্ত হ্‌জ্জ ইসলামের অন্যতম মৌল স্তম্ভ হওয়া সত্ত্বেও তারা এটি পালন করতে পারছিলো না। তাই কা’বা শরীফ জিয়ারত ও হজ্জ উদযাপন করার জন্যে মুসলমানদের মনে তীব্র বাসনা জাগলো।

কা’বা জিয়ারতের জন্যে সফর

আরবরা সাধারণত তামাম বছরব্যাপী যুদ্ধে মেতে থাকতো। কিন্তু হজ্জ উপলক্ষে লোকেরা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে কা’বা পর্যন্ত যাতায়াত করতে এবং নিশ্চিন্তে আল্লাহর ঘরের জিয়ারত সম্পন্ন করতে পারে, এজন্যে চার মাসকাল তারা যুদ্ধ বন্ধ রাখতো। ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে হযরত (স) কা’বা জিয়ারতের সিদ্ধান্ত নিলেন। এহেন সৌভাগ্য লাভের জন্যে বহু আনসার ও মুহাজির প্রতীক্ষা করছিলো। তাই চৌদ্দ শ’ মুসলমান হযরত (স)-এর সহগামী হলেন। যুল হুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা কুরবানীর প্রাথমিক রীতিসমূহ পালন করলেন। এভাবে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, মুসলমানদের উদ্দেশ্য শুধু কা’বা শরীফ জিয়ারত করা, কোনোরূপ যুদ্ধ বা আক্রমণের অভিসন্ধি নেই। তবুও কুরাইশদের অভিপ্রায় জেনে আসবার জন্যে হযরত (স) এক ব্যক্তিকে মক্কায় প্রেরণ করলেন। সে এই মর্মে খবর নিয়ে এলো যে, কুরাইশরা সমস্ত গোত্রকে একত্রিত করে মুহাম্মদ (স)-এর মক্কায় প্রবেশকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন কি, তারা মক্কার বাইরে এক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করতেও শুরু করেছে এবং মুকাবিলার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে আছে।

কুরাইশদের সঙ্গে আলোচনা

এই সংবাদ জানার পরও হযরত (স) সামনে অগ্রসর হলেন এবং হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে যাত্রা বিরতি করলেন। এ জায়গাটি মক্কা থেকে এক মঞ্জিল দূরে অবস্থিত।৪৫ এখানকার খোজায়া গোত্রের প্রধান হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হয়ে বললো : ‘কুরাইশরা লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা আপনাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।’ হযরত (স) বললেন : ‘তাদেরকে গিয়ে বলো যে, আমরা শুধু হজ্জের নিয়্যাতে এসেছি, লড়াই করার জন্য নয়। কাজেই আমাদেরকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ ও জিয়ারত করার সুযোগ দেয়া উচিত।’ কুরাইশদের কাছে যখন এই পয়গাম গিয়ে পৌঁছলো, তখন কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক বলে উঠলো : ‘মুহাম্মদের পয়গাম শোনার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই।’ কিন্তু চিন্তাশীল লোকদের ভেতর থেকে ওরওয়া নামক এক ব্যক্তি বললো : ‘না, তোমরা আমার উপর নির্ভর করো; আমি গিয়ে মুহাম্মদ (স)-এর সঙ্গে কথা বলছি।’

ওরওয়া হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হলো বটে, কিন্তু কোনো বিষয়েই মীমাংসা হলো না। ইতোমধ্যে কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর হামলা করার জন্যে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করলো এবং তারা মুসলমানদের হাতে বন্দীও হলো; কিন্তু হযরত (স) তাঁর স্বভাবসুলভ করুণার বলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং তাদেরকে মুক্তি দেয়া হলো। এর পর সন্ধির আলোচনা চালানোর জন্যে হযরত উসমান (রা) মক্কায় চলে গেলেন; কিন্তু কুরাইশরা মুসলমানদেরকে কা’বা জিয়ারত করার সুযোগ দিতে কিছুতেই রাযী হলো না; বরঞ্চ তারা হযরত উসমান (রা)-কে আটক করে রাখলো।

রিযওয়ানের শপথ

এই পর্যায়ে মুসলমানদের কাছে এই মর্মে সংবাদ পৌঁছলো যে, হযরত উসমান (রা) নিহত হয়েছেন। এই খবর মুসলমানদেরকে সাংঘাতিকভাবে অস্থির করে তুললো। হযরত (স) খবরটি শুনে বললেন : ‘আমাদেরকে অবশ্যই উসমান (সা)-এর রক্তের বদলা নিতে হবে।’ একথা বলেই তিনি একটি বাবলা গাছের নীচে বসে পড়লেন। তিনি সাহাবীদের কাছ থেকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করলেন : ‘আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো, তবু লড়াই থেকে পিছু হটবো না। কুরাইশদের কাছ থেকে আমরা হযরত উসমান (রা)-এর রক্তের বদলা নেবোই।’ এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুসলমানদের মধ্যে এক আশ্চর্য উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো। তারা শাহাদাতের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে কাফিরদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হলেন। এরই নাম হচ্ছে ‘রিযওয়ানের শপথ’। কুরআন পাকেও এই শপথের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে সব ভাগ্যবান ব্যক্তি এ সময় হযরত (স)-এর পবিত্র হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে পুরস্কৃত করার কথা বলেছেন।

হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তাবলী

মুসলমানদের এই উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা কুরাইশদের কাছেও গিয়ে পৌঁছলো। সেই সঙ্গে এ-ও জানা গেলো যে, হযরত উসমান (রা)-এর হত্যার খবর সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে কুরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে সুহাইল বিন্‌ আমরকে দূত বানিয়ে পাঠালো। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলী স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্যে হযরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (স)-এর তরফ থেকে তখন কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বললো : ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ একথায় সাহাবীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হযরত আলী (রা) কিছুতেই এটা মানতে রাযী হলেন না। কিন্তু হযরত (স) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রাসূল।’ এরপর নিম্নোক্ত শর্তাবলীর ভিত্তিতে সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হলোঃ

১. মুসলমানরা এ বছর হজ্জ না করেই ফিরে যাবে।
২. তারা আগামী বছর আসবে এবং মাত্র তিন দিন থেকে চলে যাবে।
৩. কেউ অস্ত্রপাতি নিয়ে আসবে না। শুধু তলোয়ার সঙ্গে রাখতে পারবে: কিন্তু তাও কোষবদ্ধ থাকবে, বাইরে বের করা যাবে না।
৪. মক্কায় সে সব মুসলমান অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কোনো মুসলমান মক্কায় ফিরে আসতে চাইলে তাকেও বাধা দেয়া যাবে না।
৫. কাফির বা মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ মদীনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলমান মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেয়া হবে না।
৬. আরবের গোত্রগুলো মুসলমান বা কাফির যে কোনো পক্ষের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
৭. এ সন্ধি-চুক্তি দশ বছরকাল বহাল থাকবে।
দৃশ্যত এই শর্তাবলী ছিলো মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী আর মুসলমানরা যে চাপে পড়েই এ সন্ধি করেছিলো, তাও বেশ বোঝা যাচ্ছিলো।

হযরত আবু জান্দালের ঘটনা

সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে সুহাইলের পুত্র হযরত আবু জান্দাল (সা) মক্কা থেকে পালিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শৃংখলিত অবস্থায় মুসলমানদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা শোনালেন। তাঁকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কি কি ধরণের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা-ও সবিস্তারে খুলে বললেন। অবশেষে তিনি হযরত (স)-এর কাছে আবেদন জানালেন : ‘হুযুর আমাকে কাফিরদের কবল থেকেকে মুক্ত করে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন ।’ একথা শুনে সুহাইল বলে উঠলো : ‘দেখুন, সন্ধির শর্ত নিয়ে যেতে পারেন না।’ এটা ছিলো বাস্তবিকই এক নাজুক সময়। কারণ, আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে নির্যাতন ভোগ করছিলেন এবং বারবার ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন : ‘হে মুসলিম ভাইগণ! তোমরা কি আমাকে আবার কাফিরদের হাতে তুলে দিতে চাও?’ সমস্ত মুসলমান এই পরিস্তিতিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলো। হযরত উমর (রা) তো রাসূলুল্লাহ (স)-কে এ পর্যন্ত বললেন যে, ‘আপনি যখন আল্লাহর সত্য নবী, তখন আর আমরা এ অপমান কেন সইব? হযরত (স) তাকে বললেন : ‘আমি খোদার পয়গাম্বর, তাঁর হুকুমের নাফরমানী আমি করতে পারিন না। খোদা-ই আমায় সাহায্য করবেন।’

মোটকথা, সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হলো। সন্ধির শর্ত মুতাবেক আবু জান্দালকে ফিরে যেতে হলো। এভাবে ইসলামের পথে জীবন উৎসর্গকারীরা রাসূলের আনুগত্যের এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। একদিকে ছিলো দৃশ্যত ইসলামের অবমাননা ও হযরত আবু জান্দালের শোচনীয় দুর্গতি আর অন্যদিকে ছিলো রাসূলুল্লাহ (স) -এর নিরংকুশ আনুগত্যের প্রশ্ন।

হযরত (স) আবু জান্দালকে বললেন : ‘আবু জান্দাল! ধৈয্য ও সংযমের সাথে কাজ করো। খোদা তোমার এবং অন্যান্য মজলুমের জন্যে কোনো রাস্তা বের করে দিবেনই। সন্ধি-চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। কাজেই আমরা তাদের তাদের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারি না।’ তাই আবু জান্দালকে সেই শৃংখলিত অবস্থায়ই ফিরে যেতে হলো।

হুদাইবিয়া সন্ধির প্রভাব

সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হবার পর হযরত (স) সেখানেই কুরবানী করার জন্যে লোকদেরকে হুকুম দিলেন। সর্বপ্রথম তিনি নিজেই কুরবানী করলেন। সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর হযরত (স) তিন দিন সেখানে অবস্থান করলেন। ফিরবার পথে সূরা ফাতাহ নাযিল হলো। তাতে এই সন্ধির প্রতি ইঙ্গিত করে এতে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করা হলো। যে সন্ধি-চুক্তি মুসলমানরা চাপে পড়ে সম্পাদন করলো, তাকে আবার ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যা দেয়া দৃশ্যত একটি বেখাপ্পা ব্যাপার ছিলো। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্টত প্রমাণ করে দিলো যে, ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবয়ার সন্ধি ছিলো একটি বিরাট বিজয়ের সূচনা মাত্র। এর বিস্তৃত বিবরণ হচ্ছে নিম্নরূপ :

এতদিন মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যে পুরোপুরি একটা যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করছিলো। উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশার কোনোই সুযোগ ছিলো না। এই সন্ধি-চু্‌ক্তি সেই চরম অবস্থার অবসান ঘটিয়ে রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিলো। এরপর মুসলমান ও অমুসলমানরা নির্বাধে মদীনায় আসতে লাগলো। এভাবে তারা এই নতুন ইসলামী সংগঠনের লোকদেরকে অতি নিকট থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেলো। এর পরিণতিতে তারা বিস্ময়কর রকমে প্রভাবিত হতে লাগলো। যে সব লোকের বিরুদ্ধে তাদের মনে ক্রোধ ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়েছিলো, তাদেরকে তারা নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে আপন লোকদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত মানের দেখতে পেলো। তারা আরো প্রত্যক্ষ করলো, আল্লাহর যে সব বান্দাহর বিরুদ্ধে তারা এদ্দিন যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করে আসছে, তাদের মনে কোনে ঘৃণা বা শত্রুতা নেই; বরং তাদের যা কিছুই ঘৃণা, তা শুধু বিশ্বাস ও গলদ আচার-পদ্ধতির বিরুদ্ধে। তারা (মুসলমানরা) যা কিছুই বলে,তার প্রতিটি কথা সহানুভূতি ও মানবিক ভাবধারায় পরিপূর্ণ। এতো যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও তারা বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সহানুভূতি সদাচরণের বেলায় কোনো ত্রুটি করে না।

পরন্ত এরূপ মেলামেশার ফলে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের সন্দেহ ও আপত্তিগুলো সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা করাও প্রচুর সুযোগ হলো। এতে করে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা কতোখানি ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো, তা তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলো। মোটকথা, এই পরিস্থিতি এমনি এক আবহাওয়ার সৃষ্টি করলো যে, অমুসলিমদের হৃদয় স্বভাবতঃই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। এর ফলে সন্ধির-চুক্তির মাত্র দেড়-দুই বছরের মধ্যে এতো লোক ইসলাম গ্রহণ করলো যে, ইতঃপূর্বে কখনো তা ঘটেনি। এরই মধ্যে কুরাইশদের কতিপয় নামজাদা সর্দার ও যোদ্ধা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলো এবং অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলালো।

হযরত খালিদ বিন্‌ অলিদ (রা) এবং হযরত আমর বিন্‌ আস (রা) এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করলেন। এর ফলে ইসলামের প্রভাব-বলয় এতোটা বিস্তৃত হলো এবং তার শক্তিও এতোটা প্রচণ্ড রূপ পরিগ্রহ করলো যে, পুরনো জাহিলিয়াত স্পষ্টত মৃত্যু-লক্ষণ দেখতে লাগলো। কাফির নেতৃবৃন্দ এই পরিস্থিতি অনুধাবণ করে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠলো। তারা স্পষ্টত বুঝতে পারলো, ইসলামের মুকাবিলায় তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই অনতিবিলম্বে সন্ধি-চুক্তি ভেঙে দেয়ার এবং এর ক্রমবর্ধমান সয়লাবকে প্রতিরোধ করার জন্যে আর একবার ইসলামী আন্দোলনের সাথে ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তারা খুঁজে পেলো না। এই চুক্তি ভঙ্গের কথা পরে মক্কা বিজয় প্রসঙ্গে আলোচিত হবে।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম