অধ্যায় ০৮ : মদীনায় আন্দোলনের নতুন পর্যায়

মদিনায় শুভাগমন

হযরত(সা:) এর আগমন বার্তা পূর্বেই পৌঁছেছিল গোটা শহরই তার শুভাগমনের জন্যে প্রতিক্ষমান ছিল। ছোট-বড় সবাই প্রতিদিন সকালে শহরের বাইরে গিয়ে জমায়েত হতো এবং দুপুর পর্যন্ত ইন্তেজার করে ফিরে আসতো। অবশেষে একদিন তাদের সেই প্রতিক্ষিত শুভ মুহূর্তটি এসেই পড়লো। দূর থেকে হযরত (সা:) এর আসবার আলামত দেখে গোটা শহরটি তকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। প্রতিটি প্রতিক্ষাকারী হৃদয় উজার করে তাকে স্বাগত জানালো। মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে ‘কুবা’ নামক স্থানে আনসারদের অনেকগুলো খান্দান বসবাস করতো। এদের মধ্যে আমর ইবনে আওফের খান্দান টি ছিল সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয়। কুলসুম বিন আল হাদাম ছিলেন এদের প্রধান ব্যক্তি। এর পরম সৌভাগ্য যে, দো-জাহানের নেতা সবার আগে এরই আতিথ্য কবুল করেন এবং কুবাই এর গৃহেই অবস্থান করেন। হযরত (সা:) এর রওয়ানার তিন দিন পর হযরত আলী(রা:) মক্কা থেকে যাত্রা করেছিলেন ; তিনিও এখানে এসে হযরত (সা:) এর সঙ্গে মিলিত হলেন।

কুবায় হযরত (সা:) শুভাগমন করেন নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরের ৮ রবিউল আওয়াল (মুতাবেক ২০সেপ্টেম্বর , ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ)।এখানে অবস্থানকালে তার পয়লা কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা । তিনি তার পবিত্র হস্ত দ্বারা এইমসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং অন্যসাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে এর নির্মানকাজ সম্পূর্ণ করেন। কয়েকদিন অবস্থান করে তিনি শহরের দিকে রওয়ানা করলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার । পথে বনী সালেমের মহল্লা পর্যন্ত পৌঁছলে জুহর নামাজের সময় হলো। এখানে তিনি সর্বপ্রথম জুম’আর খুতবা প্রদান করেন এবং প্রথম বার জুম’আর নামাজ পড়ালেন।

মদিনায় প্রবেশকালে প্রতিটি আত্মোৎসর্গী মুসলিমের হৃদয়েই তার মেহমানদারীর সৌভাগ্য লাভের আকাঙ্খা জাগলো। তাই প্রত্যেক গোত্রের লোকই তার সামনে এসে আবেদন জানাতে লাগলো :‘হুযুর, এই হচ্ছে আপনার ঘর, অনুগ্রহ করে এখানে আপনি অবস্থান করুন। লোকদের মধ্যে এতখানি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হলো যে প্রতিটি হৃদয়ই যেন পথের ফরাশে পরিণত হলো; প্রতিটি হৃদয়ই উৎসর্গীকৃত হবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো। এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত গৃহের ছাদে উঠে গাইতে লাগলোঃ

চন্দ্র উদিত হয়েছে,
বিদা পর্বতের ঘাঁটি থেকে, খোদার শোকর আমাদের কর্তব্য, ,
যতক্ষণ প্রার্থনাকারীরা প্রার্থনা করে। ,
কিশোরী বালিকারা দফ বাজিয়ে বাজিয়ে গাইতে লাগলোঃ ,
আমরা নাজ্জার খান্দানের বালিকা ,
(আর) মুহাম্মদ(সা:) আমাদের কত উত্তম পড়োশী! ,

হযরত(সা:) বালিকাদের জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমরা কি আমায় ভালোবাস ? তারা বললো ,হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ ‘আমিও তোমাদের ভালোবাসি।’

মদিনায় অবস্থান

হযরত(সা:) এর মেহমানদারীর সৌভাগ্য কে লাভ করবে? এমন একটি প্রশ্ন যে এর মিমাংসা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। হযরত বললেন যে, আমার উষ্ট্রী যার গৃহের সামনে দাঁড়াবে , এ খেদমত সেই আজ্ঞাম দিবে। ’ ঘটনাক্রমে এ সৌভাগ্য টুকু হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা) এর ভাগ্যে পড়লো। বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী অবস্থিত , তার নিকটেই ছিল তার গৃহ। গৃহটি ছিল দ্বিতল বিশিষ্ট । তিনি হযরত (সা:) এর থাকবার জন্যে ওপরের তলাটি পেশ করেন। কিন্তু লোকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে হযরত (সা:) নিচের তলায় থাকা পছন্দ করলেন্‌ হযরত আবু আইয়ুব এবং তার স্ত্রী নিচের তলা ছেড়ে ওপরের তলায় চলে গেলেন। এখানে হযরত(সা:) সাত মাস কাল অবস্থান করলেন। এরপর তার বসবাসের জন্যে মসজিদে নববীর নিকটে একটি কোঠা নির্মিত হলো এবং সেখানেই তিনি স্থানান-রিত হলেন। কয়েক দিনের মধ্যে তার খান্দানের অন্যান্য লোকও মদিনায় চলে এলো ।

মসজিদে নববীর নির্মাণ

মদিনায় আগমনের পর সবচেয়ে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা। হযরত (সা:) যেখানে অবস্থান করছিলেন, তার নিকটেই দুই ইয়াতিমের কিছু অনাবাদী জমি ছিল। নগদ মূল্যে তাদের কাছ থেকে এই জমিটি খরিদ করা হলো। তারই ওপর মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হলো। এবারও হযরত(সা:) সাধারণ মজুরের ন্যায় সবার সাথে মিলে কাজ করলেন। স্বহস্থে তিনি ইট-পাথর বয়ে আনলেন। মসজিদটি অত্যন্ত সাদাসাদি ভাবে নির্মিত হলো। কাঁচা ইটের দেয়াল, খেজুর গাছের খুঁটি এবং খেজুর পাতার ছাদ - এই ছিল এর উপকরণ। মসজিদের কিবলা হলো বায়তুল মুকাদ্দিসের দিকে। কেননা, তখন পর্যন্ত মুসলমানদের কিবলা ছিল ‌ঐ দিকে। অতঃপর কিবলা কা’বামুখী হলে তদনুযায়ী মসজিদের সংস্কার করা হলো। মসজিদের একপাশে একটি উঁচু চত্বর নির্মিত হলো। এর নাম রাখা হলো ‘ সুফফা’। যে সব নও মুসলিমের কোন বাড়ি-ঘর ছিলো না। এটি ছিল তাদের থাকবার জায়গা।

মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে তার নিকটেই হযরত (সা:) তার স্ত্রীদের জন্যে কয়েকটি কোঠা তৈরি করে নিলেন। এগুলো কাঁচা ইট এবং খেজুর গাছ দ্বারা নির্মিত হলো। এই ঘরগুলো ছয়-সাত হাত করে চওড়া এবং দশ হাত করে লম্বা ছিল। এর ছাদ এতোটা উঁচু ছিল যে, একজন লোক দাঁড়ালে তা স্পর্শ করতে পারতো। দরজায় ঝুলানো ছিল কম্বলের পর্দা।
হযরত(সা:) এর গৃহের নিকটে যে সব আনসার বাস করতো, তাদের ভিতরকার স্বচ্ছল লোকেরা তার খেদমতে কখনো তরকারী , কখনো বা অন্য কিছু পাঠাতো। এর দ্বারাই তার দিন গুজরান হতো; অর্থাৎ সংকটের ভেতর দিয়েই তার জীবন-যাত্রা নির্বাহ হতো।

ভাই ভাই সম্বন্ধ

মক্কা থেকে যে সব মুসলমান ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে মদিনায় চলে এসেছিল, তাদের প্রায় সবাই ছিল সহায় সম্বলহীন। তাদের মধ্যে যারা স্বচ্ছল ছিল, তারাও নিজেদের মাল-পত্র মক্কা থেকে আনতে পারেন নি। তাদের সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে একদম রিক্ত হস্তেই আসতে হয়েছিল। এই সব মুহাজির যদিও মুসলমানদের (আনসার) মেহমান ছিলো, তথাপি এদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল । তাছাড়া এরা নিজেরাও স্বহস্থে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে ভালবাসতো। তাই মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে একদিন হযরত (সা:) আনসারদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি এবং মুহাজিরদের ভেতর থেকে এক ব্যক্তিকে ডেকে বললেন, ‘আজ থেকে তোমরা পরস্পর ভাই ।’ এভাবে সমস- মুহাজিরকে তিনি আনসারদের ভাই বানিয়ে দিলেন। তার ফলেই আল্লাহর এই খাঁটি বান্দাগণ শুধু ভাই-ই নয়, পরস্পরে ভাইয়ের চেয়েও ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হলেন। আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে গেল এবং তাদের সামনে নিজেদের সমস্ত সম্পত্তি ও সামান-পত্রের হিসাব করে বললো : ‘এর অর্ধেক তোমাদের আর অর্ধেক আমাদের।’ এভাবে বাগানের ফল, ঘরের সামান, বাসগৃহ, সম্পত্তি - মোটকথা, প্রতিটি জিনিসই সহোদর ভাইদের মতো বিভক্ত হলো। ফলে আশ্রয়হীন মুহাজিরগণ সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত হলো। তারা যথারীতি ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলো, দোকান-পাট খুললো এবং অন্যান্য কাজে নিযুক্ত হলো। এভাবে মুহাজির পুনর্বাসনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলো এবং এদিক দিয়ে সবাই নিশ্চিন্ত হলো।

নবপর্যায়ে ইসলামী আন্দোলন

হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হচ্ছিল মক্কার মুশরিকদের কাছে। তাদের কাছে এটা ছিল একটি অভিনব জিনিস। কিন্তু হিজরতের পর সমস্যা দেখা দিল মদিনার ইহুদীদের নিয়ে। এরা তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, ফেরেশতা, ওহী ইত্যাদি বিশ্বাস করতো এবং একজন পয়গম্বরের (হযরত মূসার ) উম্মত হিসাবে খোদার তরফ থেকে আগত একটি শরীয়াতের অনুগামী হবারও দাবিদার ছিল। নীতিগত ভাবে হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে দ্বীন-ইসলামের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তাদেরও প্রকৃত দ্বীন ছিল তা-ই। কিন্তু শতাব্দী কালের অনাচার ও বেপরোয়া আচরণের ফলে তাদের ভেতর নানারকমের দোষ-ত্রুটি দেখা দিয়েছিল ।তাদের জীবন প্রকৃত খোদায়ী শরীয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং তাদের ভেতর অসংখ্য কুসংস্কার , বিদয়াত ,ও কুপ্রথার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ।তাদের কাছে তওরাত কিতাব ছিল বটে, কিন্তু তার মধ্যে তারা বহু মানবীয় কালাম শামিল করে নিয়েছিল। তবুও তার মধ্যে খোদায়ী বিধি-বিধান যা কিছু বাকী ছিল , তাও মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ছাঁচে ফেলে তারা ওলট-পালট করে দিয়েছিল। এভাবে খোদার দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সামাজিক দিক দিয়ে তাদের ভেতর মারাত্মক সব দোষ-ত্রুটি শিকড় গেড়ে বসেছিল। আল্লাহর কোন বান্দাহ যদি তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে চাইতো, তার কোন কথা পর্যন্ত তারা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। বরং তাকে তারা ঘোরতর দুশমন বলে মনে করতো এবং তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্যে সর্বোতভাবে চেষ্টা চালাতো। যদিও তারা মিলগতভাবে মুসলিমই ছিল, তবুও তাদের এতখানি পতন ঘটেছিল যে, তাদের আসল দ্বীন কি ছিল , তা তাদের নিজেদেরই স্মরণ ছিল না।

এদিক দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের সামনে শুধু দ্বীন-ইসলামের মূলনীতি সংক্রান্ত বুনিয়াদী প্রচারের কাজই ছিলনা, বরং ঐসব বিভ্রান্ত মুসলমানের ভেতর পুনরায় দ্বীনি ভাবাদর্শ জাগ্রত করার দায়িত্বও বর্তমান ছিল। তাছাড়া হযরত (সা:) এর আগমনের পর মুসলমানেরা ক্রমান্বয়ে চারদিক থেকে এসে মদিনায় জমায়েত হচ্ছিল এবং এই সব মুহাজির ও মদিনার আনসার গণ মিলে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির ইসলামী রাষ্ট্রেরও ভিত্তি পত্তন করেছিল। ৩৭ এ কারণে আন্দোলনকে এ যাবত শুধু আদর্শ প্রচার, আকীদা-বিশ্বাসের সংস্কারে এবং কিছু নৈতিক শিক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশ প্রদান করতে হলেও, এখন সামাজিক জবিনধারার সংস্কার, প্রশাসনিক আইন-কানুন প্রণয়ন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ বিষয়ক বিধি-ব্যবস্থা জারির প্রয়োজন দেখা দিলো। সুতরাং এবার এদিকে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া হলো।

এ সময় আরো একটি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হলো। এই পর্যন্ত কুফরী পরিবেশেই ইসলামী দাওয়াত পেশ করা হচ্চিলো এবং এরই ভেতর থেকে মুসলমানরা কাফিরদের জুলুম-পীড়ন বরদাশত করছিরো। কিন্তু এবার তারা ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করলো যা চারদিকে দিয়েই ছিলো কাফিরদের দুর্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই ব্যাপারটি এখন আর শুধু উৎপীড়ন আর হয়রানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না, বরং গোটা আরব উপদ্বীপই এবার সংকল্পগ্রহণ করলো যে, এই নগন্য দলটিকে যতো শীঘ্র সম্ভব খতম করে দিতে হবে; নচেৎ ইসলামের এই কেন্দ্রটি শক্তি অর্জন করতে শুরু করলে তাদের জন্যে দাঁড়াবার স্থান পর্যন্ত থাকবে না। তাই নিজেদের এবং আন্দোলনের নিরাপত্তার তাগিদে এই নয়া ইসলামী দলের সামনে জরুরী কর্তব্য হয়ে দেখা দিলো :

১. পূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে জিদের আদর্শ প্রচার করা, দলিল প্রমাণ দ্বারা তার সত্যতা প্রতিপন্ন করা এবং যতো বেশি সম্ভব লোকদেরকে এর সমর্থক বানানোর চেষ্টা করা;
২. বিরুদ্ধবাদীগণ যে সব আকীদা-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেছিলো, যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে তার অসারতা প্রমাণ করা, যেনো বিবেকের আলোয় কেউ কিছু বুঝতে চাইলে প্রকৃত সত্য পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে কোনো বেগ পেতে না হয়:
৩. ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য নষ্ট করে যারা এই নতুন রাষ্ট্রে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের জন্যে শুধু বসবাসের ব্যবস্থাই নয়, বরং তাদেরকে উন্নত মানের নৈতিক ও ঈমানী শিক্ষা দান করা, যেনো চরম দুঃখ-দারিদ্র্য এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা পূর্ণ ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে পারে এবং কোনো কঠিনতর অবস্থায়ও তাদের পা কেঁপে না ওঠে;
৪. মুসলমানদেরকে চরম প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলার জন্যে প্রস্তুত করা, যাতে করে তাদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে বিরুদ্ধবাদীগণ কোনো সশস্ত্র হামলা চালালে নিজেদের দুর্বলতা ও অস্ত্রপাতির দৈন্য সত্ত্বেও তারা পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে শত্রুর মুকাবিলা করতে পারে এবং আপন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সত্যতা সম্পর্কে গভীরতর প্রায় ও খোদার প্রতি ঐকান্তিক নির্ভরতার কারণে ময়দান থেকে কখনো পশ্চাদপসারণ না করে;
৫. যে সব লোক নানাভাবে বুঝানো সত্ত্বেও ইসলামের কাঙ্খিত জীবন পদ্ধতির প্রতিষ্ঠার পথে বাদ সাধবে, তাদেরকে প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করে ময়দান থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে আন্দোলনের অনুবর্র্তীদের মধ্যে পূর্ণ হিম্মত ও সৎ সাহস পয়দা করা।

ইহুদীদের সঙ্গে চুক্তি

মদীনার প্রায় চারদিকেই ইহুদীদের বসতি ছিলো।৩৮এদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণেরও প্রয়োজন ছিলো। কারণ মুসলমানদের মক্কা ত্যাগের কথা জানতে পেরে কাফির কুরাইশগণ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেনি, বরং মুসলমানদের একটি সংঘবদ্ধ দলকে মদীনায় একত্রিত হতে দেখেই তারা ইসলামের এই নয়া কেন্দ্রকে আপন শক্তি ও প্রভাবে মিটিয়ে দেবার পন্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছিলো। এ কারণেই মদীনার চার দিককার ইহুদী বাসিন্দাদের সথে একটা স্পষ্টতর রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দিলো, যেনো মক্কার মুশরিকগণ কোনো হামলা চালালে ইহুদীদের ভূমিকাটা অনুমান করা যেতে পারে। তাই মদীনা ও লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ইহুদী গোত্রগুলোর সঙ্গে হযরত (স) নিরপেক্ষতার চুক্তি সম্পাদন করলেন। অর্থাৎ কুরাইশ বা অন্য কেউ যদি মদীনার মুসলমানদের ওপর হামলা করে, তাহলে এরা না মুসলমানদের পক্ষে লড়াই করবে আর না তাদের শত্রুপক্ষকে সমর্থন করবে; আর কারো সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি করা হলো যে, যদি মুসলমানদের ওপর কেউ হামলা করে, তাহলে তারা মুসলমানদেরকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে।

মুনাফিক

এ সময় মদীনায় ইসলামী আন্দোলনকে কতকগুলো নতুন সমস্যার মুকাবিলা করতে হলো। এর মধ্যে মুনাফিকদের সমস্যাটি ছিলো অতীব গুরুত্ব্‌পূর্ণ। মক্কায় শেষ পর্যায়ে এমন কিছু লোক ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো, যারা ইসলামী দাওয়াতকে সম্পূর্ণ সত্য বলে জানতো বটে, কিন্তু ঈমানের দুর্বলতাবশত ইসলামের খাতিরে পার্থিব স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলো না। চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আত্নীয়তা ইত্যাদি প্রায়শ ইসলামের দাবি পূরণের পথে তাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু মদীনায় আসার পর এমন কিছু লোকও ইসলামী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করলো, যারা আদতেই ইসলামে বিশ্বাসী ছিলো না। এরা নিছক ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ইসলামী সংগঠনে শামিল হয়েছিল। আবার কিছু লোক অক্ষমতা হেতু নিজেদেরকে মুসলমান বলে জাহির করতো। এদের হৃদয় যদিও ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু নিজ গোত্র বা খান্দানের বহু লোক মুসলমান হবার ফলে এরা বাধ্য হয়ে মুসলমানের দলে শামিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে আরো কিছু সুযোগ সন্ধানী লোকও ইসলামী সংগঠনে ঢুকে পড়েছিল । এরা একদিকে মুসলমানদের সঙ্গী হয়ে পার্থিব ফায়াদা হাসিলের চিন্তা করতো, অন্যদিকে কাফিরদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। এদের চেষ্টা ছিল ইসলাম ও কুফরের সংঘর্ষে যদি ইসলামী বিজয়ী হয়, তাহলে এরা যেন ইসলামের মধ্যে আশ্রয় পেতে পারে আর যদি কুফর জয়লাভ করে , তবুও যেন এদের স্বার্থ নিরাপদ থাকে।

ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে এই মিত্রবেশী শত্রুরাই ছিল সবচেয়ে বেশি অসুবিধার কারণ। এদের সঙ্গে কাজ-কারবার করা মোটেই সহজতর ছিল না। মদিনার গোটা জীবনে এই শ্রেণীর লোকদের সৃষ্ট ফিতনার কিভাবে মুকাবেলা করা হয়, যথাস্থানে তা আলোচিত হবে। এখানে শুধু ঐ শ্রেণীর মুনাফিক আর সাচ্চা মুমিনদের তুলনামূলক পরিচয়টা জেনে রাখারই প্রয়োজন বেশি। কারণ এইসময় ইসলামী আন্দোলন কে এক সংকটজনক পরিস্থিতির মুকাবেলা করতে হয় এবং এ কারণেই যেসব লোক পুরানো বিদ্বেষ এবং ইসলাম বিমুখ চিন্তাধারা আঁকড়ে ধরে ছিল অথবা যাদের ঈমান কোন দিক দিয়ে দুর্বল ছিল , আন্দোলন থেকে তাদের সরে পড়বার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল।

কিবলা পরিবর্তন

এ যাবত ইসলামের কিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। এদ্দিন ঐদিকে মুখ করেই মুসলমানরা নামায পড়তো। বায়তুল মুকাদ্দাসের সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠতর । এরাও ঐদিকে মুখ করে উপাসনা করতো। দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে একদিন ঠিক নামাজের মধ্যে কিবলা পরিবর্তন করার নির্দেশ এলো এবং তখন থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের বদলে কা’বাকে মুসলমানদের কিবলা বলে ঘোষণা করা হলো। তাই হযরত (সা:) নামাজের মধ্যেই তার মুখ বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কা’বার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । খোদ আল্লাহ তাআলা এর গুরুত্ব নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেনঃ
“আমরা কা’বাকে তোমাদের কিবলা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এর কারণ হচ্ছে, কে পয়গম্বরের অনুবর্তী আর কে পশ্চাদপসরণকারী , তা যাচাই করে নেয়া”।

এর দ্বারা এ সত্য ঘোষিত হলো যে, এ যাবত দুনিয়ার নৈতিক এবং ঈমানী নেতৃত্বের যে দায়িত্ব ইহুদীদের ওপর ন্যস্ত ছিল , তা থেকে তাদেরকে অপসারণ করা হয়েছে। কারণ তারা এ দায়িত্ব পালন করেনি এবং এ নিয়ামতটির কদরও বুঝতে পারেনি। তাই তাদের বদলে এ খেদমতের দায়িত্ব এখন উম্মতে মুসলিমার ওপর ন্যস্ত করা হলো। তারা এই কর্তব্য পালন করে যাবে।
এই ঘটনার প্রভাবে বহু কপট মুসলমানেরই -যাদের হৃদয়ে ঈমানের আসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি - মুখোশ খসে পড়লো। তারা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর এই কার্যের তীব্র সমালোচনা করলো। এর ফলে ইসলামী আন্দোলনে এইসব লোকের ভূমিকা কি, তাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো। এভাবে বহু দো-দিল বান্দাহ ইসলামী সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং এই শ্রেণীর মিত্ররুপী শত্রুদের দুষ্ট প্রভাব থেকে আন্দোলনও বহুলাংশে মুক্ত হলো।

0 comments:

Comment Please

মন্তব্য..

সবিস্তার সূচীপত্র
টেম্পলেট কাষ্টমাইজেশন - তরঙ্গ ইসলাম | তরঙ্গ ইসলাম